Rangoon Passenger Shed and Babu Mukhram Kanoria

How Babu Mukhram Kanoria came forward to built 'Rangoon Passenger Shed' for fellow Indian.

প্লটুন ব্রিজের নিকুঞ্জ মোহন

An incident happened on Floating Howrah Bridge on 1877.

Champatala Ghat

Read full story on Champatala Ghat.

Refuge House of Kolkata Port

At the mouth of Sundarban, Kolkata Port established some shelters for Sea wrecked, Known as Refuge House.

'Bandel Survey' : A legacy of Colonial India

WB Survey Institute: legacy of a British colonial survey institute through an unique history.

Jan 30, 2024

গঙ্গা গঙ্গা

 

যে খেজুরি বন্দর দিয়ে রাজা রামমোহন রায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ইংল্যান্ডে পাড়ি দিয়েছিলেন, ১৮৬৪ সালের এক বিধ্বংসী ঘূর্ণি ঝড়ে তা ধ্বংস হয়ে যায়। ঐ একই বছরে সুন্দরবনে বিদ্যাধরী ও মাতলা নদীর সংযোগ স্থলে তৈরি হয় পোর্ট ক্যানিংঘূর্ণি ঝড়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়া পোর্ট ক্যানিংএর মুরিং গুলো যখন ১৮৭১ সাল নাগাদ তুলে ফেলা হচ্ছে সে সময় কলকাতার হুগলী নদীতে নতুন করে গড়ে উঠছে একের পর এক জেটি। এ যেন নদীর একুল ভেঙ্গে ওকুল গড়ার মত। যে গঙ্গা, পদ্মা হয়ে গিয়েছে ওপার বাংলায় সেই গঙ্গাই ভাগিরথী হয়ে হুগলী তে এসে হুগলী । সে তো গঙ্গাই। প্রথমে কলকাতা বন্দর মেরিন বিভাগের হাতে ছিল। ১৮৬৯ সাল পর্যন্ত গঙ্গায় গোটা চারেক জেটির মাধ্যমেই চলত বন্দরের কাজকর্ম। কলকাতা বন্দরের উন্নতির জন্য ১৮৬৬ সালের ‘রিভার ট্রাস্ট’ ব্যার্থ হলে ৎকালীন লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার উইলিয়াম গ্রে-র তৎপরতায় ১৮৭০ সালে কলকাতা বন্দরের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় সেই সময় বাংলার ভাগ্যাকাশে বিষাদের সুর। বিদ্যাসাগরের অন্যতম সেরা বন্ধু, যার নামে তালতলা অঞ্চলের দুর্গাচরণ ডাক্তার রোড, রাষ্ট্রগুরুর পিতা ডাক্তার দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় অস্তাচলে গেলেনকথিত আছে শ্রীশ্রীঠাকুরের গলরোগের প্রথম অবস্থায় এই ডাক্তারের বাড়িতে দক্ষিণেশ্বর হইতে নৌকা করে এসেছিলেনআর চলে গেলেন দেশের প্রথম বৈজ্ঞানিক,ডিরজিওর ইয়ংবেঙ্গলের উজ্জ্বল সদস্য, বিজ্ঞানসাধক, জরিপবিদ, গনিতজ্ঞ ও এভারেস্ট শৃঙ্গ আবিষ্কারক রাধানাথ সিকদার আর ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ খ্যাত কালীপ্রসন্ন সিংহ। সেই কালীপ্রসন্ন সিংহ যিনি দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটক অনুবাদের অভিযোগে জেমস লঙের এক মাসের কারাদন্ড ও এক হাজার টাকা জরিমানা হলে পরিশোধকারী, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্তৃক অনুপ্রাণিত হয়ে বিধবা-পুনর্বিবাহ প্রবর্তনের লক্ষ্যে সক্রিয় অংশ গ্রহণকারী, বাংলা সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তনের জন্য মাইকেল মধুসূদন দত্তকে গণসংবর্ধনা জ্ঞাপনকারী, প্রসিদ্ধ হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বন্ধের উপক্রম হলে প্রচুর অর্থ সাহায্যকারীতাঁর অসাধারণ সাহিত্যকর্ম ছিল হুতোম প্যাঁচার নকশাএবং ‘পুরাণসংগ্রহ’। সামাজিক ছবি আর ব্যাক্তি বিশেষ কে বিদ্রুপ এই দুই নিয়েই ছিল হুতোমের নকশা। নীলদর্পণ নাটক অনুবাদের অভিযোগ সংক্রান্ত বিষয়ে হুতোম প্যাঁচার নকশা’ তে লিখছেন, “প্রজার দুরবস্থা শুনতে ইণ্ডিগোকমিসন্ বসলো, ভারতবর্ষীয় খুড়ীর চমকা ভেঙ্গে গ্যাল (খুড়ী একটু আফিম খান)। বাঙ্গালির হয়ে ভারতবর্ষীয় খুড়ীর একজন খুড়ো কমিসনর হলেন। কমিসনে কেঁচো খুঁড়তে খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়লো; সেই সাপের বিষে নীলদর্পণ জন্মালো; তার দরুণ নীলকর দল হন্নে হয়ে উঠলেন,—ছাই গাদা, কচুবন, ফ্যান গোঁজলা ছেড়ে দিয়ে ঠাকুর ঘরে, গিরজেয়, প্যালেসে ও প্রেসে তাগ কল্লেন ! শেষে ঐ দলের একটা বড় হঙ্গেরিয়ান হাউণ্ড পাদরি লং সায়েবকে কামড়ে দিলে!”। এই বছরেই ভুবনমোহন দাস নিস্তারিণীদেবীর ঘর আলো করে জন্ম নিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস। আর বাংলার বুদ্ধিজীবী ও ব্রাহ্ম নেতা কেশব চন্দ্র সেন তার অনুগামীদের নিয়ে স্থাপন করলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পথপ্রদর্শক ইন্ডিয়ান রিফর্মার অ্যাসোসিয়েশন বা ভারত সংস্কার সভা। ব্রহ্মানন্দ কেশব চন্দ্র সেন ছিলেন অসাধারন বাগ্মি, ব্রাহ্মসমাজের আচার্য। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তার গোষ্ঠীর সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ নামে পৃথক সমাজ গঠন করেন। তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মবিবাহের রীতি ভঙ্গ করে কুচবিহার রাজ পরিবারে কন্যার বিবাহ দেওয়ায় তার গোষ্ঠীর একাংশ পৃথক হয়ে যায়। তৎকালীন সমাজে বই ছাপিয়ে কেচ্ছা করার রীতি এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে, শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছিলেন আঠাশ পাতার পুস্তিকা এই কি ব্রাহ্মবিবাহ?’ আর এক ব্রাম্ভ আনন্দচন্দ্র মিত্র ছদ্মনামে লিখেছিলেন “কপালে ছিল বিয়ে কাঁদলে হবে কি”

বাঁ দিক থেকেঃ নবগোপাল মিত্র,অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

১৮২০ সাল নাগাদ কলকাতার স্ট্রান্ড রোডের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। জমি অধিগ্রহণ এবং রাস্তা তৈরীর কাজে খরচা করেছিল সরকার প্রতিষ্ঠিত লটারি কমিটি।এরপরই কলকাতার দিকের ডক গুলি সব চলে যায় নদীর উল্টো দিকে হাওড়ায়। ১৮৩৮ সাল নাগাদ স্ট্রান্ড রোড থেকে নদীর দিকে আড়াআড়ি ভাবে বেশ কয়েকটি স্পার নির্মাণ করা হয় যাতে ফোর্ট উইলিয়ামের সামনের জমি রক্ষা করা যায় । তারপর কালক্রমে স্পারের মধ্যবর্তী জায়গা গুলোতে শহরের ময়লা আবর্জনা রাবিশ ইত্যাদি ফেলে জমিগুলো আস্তে আস্তে ভরাট হল। এই জমিই ‘স্ট্যান্ড ব্যাংক ল্যান্ড’ । বিভিন্ন বানিজ্যিক কাজে এইজমির ব্যবহার সুরু হলে প্রাপ্ত আয় থেকে চাঁদপাল ঘাট ও হেস্টিংস এর মধ্যবর্তী রোড, ময়দানের ড্রেন, ইডেন গার্ডেনেন্স ইত্যাদির রক্ষনাবেক্ষন হতে থাকে। ১৮৭১ সাল নাগাদ এই ‘স্ট্যান্ড ব্যাংক ল্যান্ড’ কলকাতা বন্দরের হাতে তুলে দেয়া হয়। আহিরিটোলা হতে কাশিপুর অবধি গঙ্গা তীরবর্তী অধুনা স্ট্যান্ড ব্যাংক রোড তৈরির জন্য ১৮৭১ সালে যখন কলকাতা বন্দর আর জাস্টিস অফ পিসের সার্ভেয়াররা একসঙ্গে যুগ্ম পরিদর্শনে বেরিয়েছেন তখন সার্ভেয়ার মিস্টার রুই মতামত দিচ্ছেন গঙ্গাতীরবর্তী জমি এবং বাড়ির ক্ষতিপূরণের জন্য প্রতি কাটায় দুই হাজার টাকাই যথেষ্ট। 


ঐ বছর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক 1862 সালে শুরু করা ইংরেজি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ইন্ডিয়ান মিরর দৈনিক পত্রিকায় পরিণত হচ্ছে। ভারতীয়দের দ্বারা পরিচালিত এটিই প্রথম দৈনিক পত্রিকা। ঐ সালেই কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করলেন রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র অবন ঠাকুরঅবনীন্দ্রনাথ। পিতা গুণেন্দ্রনাথ হয়তবা জানতেন ছেলের বিশেষ গুণের কথা।ভবিষ্যতে অবনীন্দ্রনাথ চিত্রকলার পাঠ নেবেন আর্ট স্কুলের শিক্ষক ইতালীয় শিল্পী গিলার্ডি, ইংরেজ শিল্পী সি এল পামারের কাছেমহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তাধারায় ভীষণভাবে প্রভাবিত কলকাতার সম্ভ্রান্ত বাঙালি কায়স্থ পরিবারের সন্তান নবগোপাল মিত্র শিল্পকলা, সংগীত এবং শারীরশিক্ষা চর্চার জন্যে ১৮৭২ সালে ন্যাশনাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষাক্রমের মধ্যে ছিল অঙ্কন, মডেলিং, জ্যামিতিক অঙ্কন, স্থাপত্যকলার অঙ্কন, প্রকৌশল এবং জরিপ। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠার পিছনে নবগোপাল মিত্রের সহায়তা ছিল। তিনিই প্রথম ন্যাশনাল থিয়েটার নামের প্রস্তাব করেছিলেন।‘ন্যাশনাল মিত্র’ ওরফে নবগোপাল মিত্র যে যে অগ্রগামী জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার মধ্যে ছিল ন্যাশনাল পেপার, ন্যাশনাল জিমন্যাসিয়াম, ন্যাশনাল সার্কাস ইত্যাদি।



১৮৭৩ সালে শহরে প্রথম ঘোড়ায় টানা ট্রাম চালু হয়। শিয়ালদহ থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দীর্ঘ পথে বউবাজার স্ট্রিট, ডালহৌসি স্কোয়ার, কাস্টম হাউস, স্ট্যান্ড রোড হয়ে আর্মেনিয়াম ঘাট ওখান থেকে রেল কোম্পানির স্টিমারে গঙ্গা পেরিয়ে
সোজা হাওড়া ষ্টেশন। যদিও ঐ বছরের নভেম্বর মাসে এটি বন্ধ হয়ে যায়। এই বছরেই বঙ্গবাসী প্রত্যক্ষ করলো ন্যাশনাল থিয়েটার-এর প্রথম উপস্থাপনা নীলদর্পণনাটককিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় কয়েক মাসের মধ্যেই দলাদলি অন্তর্দ্বন্দ্ব ইত্যাদি কারণে ন্যাশনাল থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়। ১৮৭২-এর ৭ই ডিসেম্বর স্থাপিত হয়ে ১৮৭৩-এ ৮ই মার্চ ন্যাশনাল থিয়েটারের দলবদ্ধ শেষ অভিনয় হয়। এরপর ন্যাশনাল থিয়েটার দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যায়। ১৮৭৩ তে ন্যাশনাল থিয়েটার দ্বিতীয় পর্ব আয়োজিত নেটিভ মেও হসপিটাল এর সাহায্যার্থে বাংলা নাট্যজগতের প্রথম সাহায্য রজনীতে ‘নীলদর্পণ’ নাটক অভিনীত হয়। একই বছরে বিহারের মুঙ্গের জেলার জামালপুরে, পিতা ডাক্তার নীলমনি ব্রহ্মচারী এবং তাঁর মাতা সৌরভসুন্দরী দেবী ঘরে জন্ম নিলেন কালাজ্বরের ঔষধ ইউরিয়া স্টিবামাইন আবিষ্কারক ও রসায়নবিদ ডাক্তার স্যার উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীব্রিটিশ শাসিত মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে ডেপুটি কালেক্টরের পদে তখন বঙ্কিমচন্দ্র। তখন বাংলার সমাজ জীবন মহন্ত এলোকেশী সংবাদে আলোড়িত। সরকারী কর্মচারী নবীন চন্দ্রের স্ত্রী এলোকেশী এবং তারকেশ্বর শিব মন্দিরের মহন্তের মধ্যে সম্পর্কের পরিনতিতে নবীন তার স্ত্রী এলোকেশীর শিরচ্ছেদ করেন। 1873 সালের তারকেশ্বর হত্যা মামলা নামে একটি বিচার শুরু হলে নবীন চন্দ্র এবং মহন্ত উভয়কেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ততকালীন বাঙালী সমাজ নবীনের স্ত্রীকে হত্যার পদক্ষেপকে ন্যায়সঙ্গত মনে করে। ফলত জনগণের ক্ষোভে দুই বছর পর নবীন মুক্তি পান । বিষয়টি কালীঘাটের পট এবং বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বাংলা নাটকের বিষয় হয়ে ওঠে, যেখানে নবীন কে একজন ভক্ত স্বামী হিসেবে দেখান হয়।

                                                                    ছোটলাল ঘাট Courtesy RCAHMS

১৮৭৪ সালে কলকাতা ও হাওড়ার মধ্যে গঙ্গা বক্ষে পরপর নৌকো সাজিয়ে ভাসমান পন্টুন ব্রিজ চালু হয়ব্রীজে যাতায়াত এর জন্য টোলআদায় করতকলকাতা পোর্ট কমিশনার। কলকাতার দিকে ব্রিজের মুখে টোল অফিস ছিলসেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল আর্মেনিয়ান ঘাটে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির আর্মেনিয়ান ফেরি স্টেশনযেখান থেকে প্যাসেঞ্জাররা ট্রেন টিকিট কাটতে পারতেন যার মধ্যে ধরা থাকত ফেরি সার্ভিস এর ভাড়া। কলকাতার রাধা বাজারের ব্যাবসায়ী ছোটলাল দুর্গাপ্রসাদ মারা যাওয়ার পরে তার উত্তরাধিকারীরা বাবুর স্মৃতিরক্ষার্থে পুরানো মল্লিক ঘাটের ঠিক উত্তরে একটি ঘাট বানানোর জন্য কলকাতা বন্দরের কাছে আবেদন করেন১৮৭৫ সালে স্থপতি রিচার্ড রোসকেল বেইনের নকশায় গড়ে উঠল ছোটলাল ঘাট ও নয়নাভিরাম মণ্ডপ এই বছরেই নেটিভ হসপিটালের গভর্নরদের টাকায় নতুন করে গড়ে উঠলো অধুনা প্রসন্ন কুমার টেগোর ঘাট যেখান থেকে ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর রবি ঠাকুর স্নান করে সূচনা করেন বঙ্গ ভঙ্গ উপলক্ষে সেই বিখ্যাত মিছিল আর এই বছরেই ব্রিটিশ বাসিন্দাদের জন্য স্থপতি রিচার্ড রোসকেল বেইনের নকশায় ম্যাকিনটোশ বার্ন দ্বারা নির্মিত কলকাতায় প্রথম পৌরবাজার নিউমার্কেট উদ্বোধন হয়। নেটিভদের চিকিৎসার প্রতি বহুদিন কোন নজর ছিল না ব্রিটিশদের, ১৭৩ সাল নাগাদ চিতপুরে একটি হসপিটাল খোলা হয় সেটি ১৭৯৬ সাল নাগাদ স্থানান্তরিত হয় ধর্মতলায় হসপিটাল স্ট্রিটে। ১৮৭৫ সালে নেটিভ হসপিটালের গভর্নর গভর্নমেন্টএর মেফান্ডের টাকায় ধর্মতলা থেকে স্থানান্তরিত হল পাথুরিয়াঘাটে গঙ্গার ধারে বন্দরের খোলামেলা জায়গায়। আগে যেখানে আগে ছিল প্রসন্ন কুমার টেগোর ঘাট। গঙ্গা তখন আর পশ্চিমে সরে গিয়েছে। নতুন তৈরি হসপিটাল উদ্বোধন করেন লর্ড নর্থব্রুক এই সালেই। চোখের চিকিৎসার জন্য এই হসপিটালের খুব সুনাম ছিল। এই হসপিটালের ছাদেই রেসিডেন্ট সার্জেন্ট ডাঃ দ্বিজেন্দ্র নাথ মৈত্রর সাহিত্য আসরে আসতেন রবীন্দ্রনাথ, কবি সত্যেন্দ্রনাথ, দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ। এই বছর প্রথম বাঙালি হিসেবে কলকাতার শেরিফ নির্বাচিত হন হুগলী জেলার কোন্নগরেকুলিন কায়স্থ পরিবারের সন্তান দার্শনিক রাজা দিগম্বর মিত্র পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে বিধবা বিবাহ চালু করার পক্ষে যে অল্প কয়েকজন মনীষী ছিলেন তাদের অন্যতম অমৃতবাজার পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক মাহাত্মা শিশির কুমার। ১৮৭৪ সালে অমৃতবাজার পত্রিকানীল বিদ্রোহকে বাংলার প্রথম বিপ্লব বলে অভিহিত করা হয়। সত্যনিষ্ঠ লেখনী ও সাংবাদিকতার মাধ্যমে নীলকরদের অত্যাচার নির্ভয়ে তুলে ধরতেন শিশির কুমার। তার নির্ভীক ও সত্যনিষ্ঠ কলম সমাজের অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে ও কৃষক শ্রেণীর পক্ষে সর্বদা সচল ফলত ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়েন শিশির কুমার এবং তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়। তার পক্ষে আদালতে সওয়াল করেন ব্যারিস্টার মনমোহন ঘোষপত্রিকাটি ক্রমশ দ্বিভাষিক হয় ও ১৮৯১ সাল থেকে দৈনিক আকারে প্রকাশ হতে থাকে। ১৮৭৫ সালে রবার্ট নাইটের সম্পাদনায় ‘ইন্ডিয়ান স্টেটসম্যান’ এবং ‘দ্য ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া’ সংবাদপত্র দুটিকে সংযুক্ত করে আত্মপ্রকাশ করে ‘দ্যা ইন্ডিয়ান স্টেটসম্যানরবার্ট নাইট যিনি পূর্বে টাইমস অফ ইন্ডিয়ার প্রধান প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ছিলেন। প্রতিদ্বন্দ্বী ‘দ্য ইংলিশম্যান’ ১৯২৭ সালে ‘দ্যা ইন্ডিয়ান স্টেটসম্যান’এর সাথে মিশে যায় । ১৮১৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল কলকাতায় জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করে।

জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা কিউরেটর ছিলেন ড্যানিশ বোটানিস্ট ড. নাথানিয়েল ওয়ালিচ।ক্রমে সংগ্রহ বাড়লে ১৮৪০ সাল নাগাদ নতুন বাড়ির প্রয়োজন দেখা দেয়। নতুন বাড়ির নকশা করেন ওয়াল্টার আর গ্র্যানভিল। ১৮৭৫ সালে ১,৪০,০০০ টাকা ব্যয়ে এই নতুন বাড়িটি তৈরি হয়।

১৮৭৬ সালে কলকাতা বন্দরের তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান ব্রুস সাহেব খিদিরপুর ডকের প্রস্তাব করেন। এই সময়ই  বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন ‘বন্দেমাতরম’ কবিতা । কবিতাটির প্রথম প্রকাশ হয় ১৮৮২ সালে ‘আনন্দমঠ’  উপন্যাসের সাথে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯৬ সালে কংগ্রেস অধিবেশনে কবিতাটি আবৃত্তি করলে সেটি বিখ্যাত হয়। ১৯০৫ সাল নাগাদ গানটি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে দেশ বন্দনার প্রতীক হয়ে ওঠে । এরপর ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস ও বন্দেমাতরম কবিতা দুটোই ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ করে। ময়মনসিংহের রাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী, ঢাকার নবাব খাজা আবদুল গণিখাজা আহসানুল্লাহ খান বাহাদুর প্রমুখের সাহায্যে ও তৎকালীন বেঙ্গল গভর্নমেন্ট এর আনুকূল্যে আলিপুর চিড়িয়াখানা গড়ে ওঠে। সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ড জুওলজিক্যাল গার্ডেন আলিপুর চিড়িয়াখানার উদ্বোধন করেনদেশবাসীকে বিজ্ঞানচর্চায় উৎসাহিত ও সুযোগদানের উদ্দেশ্যে ডক্টর মহেন্দ্রলাল সরকারের আহবানে লাট সাহেব রিচার্ড টেম্পেলের সভাপতিত্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সিলেট ভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অফ সায়েন্স বা ভারতীয় বিজ্ঞান চর্চা সংস্থার পত্তন হয়।দেশের জ্ঞানীগুণী ধনী অনেকেই তার এই মহাকাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন- উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, রাজা কমলকৃষ্ণ বাহাদুর, রাজা দিগম্বর মিত্র প্রমুখেরা।পরিচালন সমিতি গঠিত হয়েছিল তাতে দেশ হিতৈষীরা যুক্ত হন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন, অনুকূল চন্দ্র

মুখোপাধ্যায়, দ্বারকানাথ মিত্র, রমেশ চন্দ্র মিত্র প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। এই বছরেই প্রবোধ চন্দ্র বসু মল্লিককুমুদিনী বসু মল্লিকের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, দানশীল রাজা সুবোধচন্দ্র বসু মল্লিক। আর হুগলির দেবানন্দপুরে মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ও ভুবনমোহিনী দেবীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

১৮৭৭ সালে জুলাই মাসে কলকাতা বন্দরের সদর দপ্তর ১৫, স্ট্যান্ড রোডে তৈরি হলো। তার আগে সদর দপ্তর ছিল ফেয়ারলি প্লেসে অধুনা অবলুপ্ত কমার্শিয়াল বিল্ডিং থেকে। এই বছরের এপ্রিল মাসে কলকাতা পৌরসংস্থা বন্দরের সর্দার আর কুলিদের উপর লাইসেন্স ট্যাক্স বসালে সর্দার আর কুলিদের ধর্মঘটে কলকাতা বন্দর স্তব্ধ হয় ৩০সে এপ্রিল।

মহারানী ভিক্টোরিয়ার রাজরাজেশ্বরী উপাধি গ্রহণ উপলক্ষে তৎকালীন বড়লাট লর্ড লিটন যতীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মহারাজা উপাধি প্রদান করেনআর বাংলার খ্যাতিমান শিশু সাহিত্যিক ও লোককথার সংগ্রাহক দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার জন্মগ্রহণ করেন। উত্তর চব্বিশ পরগনার আরিয়াদহে ১৮৭৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন আচার্য হরিনাথ দে। ৩৪ বছরের জীবনে শিখেছিলেন কুড়িটি বিদেশি ও চোদ্দোটি ভারতীয় ভাষা, ১৮ টি ভাষায় এম এ ডিগ্রী।  অধ্যাপনা  করেছেন প্রেসিডেন্সি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে  তৎকালীন ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরী অধুনা ন্যাশনাল লাইব্রেরির
প্রথম ভারতীয় গ্রন্থাগারিক ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্ব বিভাগ তারই প্রচেষ্টায় শুরু হয়। আর ছিলেন তরু দত্ত যিনি একজন ইউরোপীয় ভাষার প্রথম মহিলা ভারতীয় লেখক হিসাবে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। ভারতের কিটস নামেও পরিচিত ছিলেন। 1877 সালে 21 বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার সংক্ষিপ্ত জীবনে, তিনি কয়েক ডজন কবিতা অনুবাদ করেন এবং 'Le Journal de Mademoiselle d'Arvers' নামে একটি উপন্যাস সম্পূর্ণ করেন, যা একজন ভারতীয় লেখকের প্রথম ফরাসি উপন্যাস। তার কাজগুলি ভারতীয় এবং ইউরোপীয় সংস্কৃতির একটি নিপুণ মিশ্রণ।

১৮৭৮ সালে স্ট্যান্ড ব্যাংক রোড তৈরির জন্য কুমোরটুলি ঘাটের কাছে রাজা রাধাকান্ত দেবের প্রতিষ্ঠিত গঙ্গা যাত্রী ঘর এবং সংলগ্ন জমি অধিগ্রহণ করে কলকাতা বন্দর। বদলে কুমোরটুলি ঘাটের ঠিক দক্ষিনে একটি নতুন গঙ্গা যাত্রী ঘর তৈরি করে দেয় কলকাতা বন্দর যার নকসা সম্ভবত স্থপতি রিচার্ড রোসকেল বেইন করেছিলেন। যে রসিক নিয়োগী ঘাটের দোতলা হলঘরে নীলদর্পণ নাটকের মহড়ায়  থাকতেন স্বয়ং রসরাজ অমৃতলাল তাও ভাঙ্গা পড়ে স্ট্যান্ড ব্যাংক রোড তৈরির কাজে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের পিতা ভুবনমোহন দাসের সম্পাদনায় ব্রাম্ভ পাবলিক পিনিয়ন নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক প্রকাশিত হয় এই বছর। আর্মেনিয়া থেকে বিতাড়িত হয়ে মেলিক রাজবংশের শেষ স্বাধীন রাজা হুগলির চুঁচড়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁরই ছেলে ডেভিড বেগলার, শিবপুরের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, নৈহাটির জুবলি ব্রিজ নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু তার মন পরে ছিল প্রত্নতাত্ত্বিক কাজে। ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক সর্বেক্ষনের প্রথম অধিকর্তা জেনারেল আলেকজান্ডার ক্যানিংহামের সহকারী হিসেবে তিনি কাজ করেন।তাকে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে দিয়েছে বাংলা বিহারের সাড়ে চার হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে শত শত মন্দির মসজিদের ছবি সম্বলিত রিপোর্ট, ১৮৭৮ সালের 'দি রিপোর্ট অফ এ ট্যুর থ্রু বেঙ্গল' বইটির জন্য।

১৮৭৯ সালে মল্লিকঘাট পাম্পিং স্টেশনের ডায়নামো দিয়ে ইলেকট্রিক ল্যাম্পএর আলোয় ভাসমান পন্টুন ব্রিজ আলোকিত করা হয়। নারীর শিক্ষার অধিকার পুরুষের সমান কিনা তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই ।১৮৫৬ সালে সরকার হিন্দু ফিমেল স্কুল অধিগ্রহণ করে এবং ১৮৬২-'৬৩ সালে এর নাম পরিবর্তন করে বেথুন স্কুল রাখা হয়। কর্ণওয়ালিস স্কোয়ারের পশ্চিমদিকে ১৮৫০ সালে বাংলার ডেপুটি গভর্নর স্যার জন লিটার একটি ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং বেথুন স্কুলকে ঐ ভবনে স্থানান্তরিত করা হয়।১৮৭৯ সালে বেথুন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ও একজন মাত্র ছাত্রী কাদম্বিনী বসুকে নিয়ে কলেজের পঠন-পাঠন শুরু হয়।


ভাসমান পন্টুন ব্রিজ

১৮৮০সালে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হাওড়ার শিবপুরের বিশপ কলেজের বিশাল ক্যাম্পাসে স্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত হয়। ফরাসডাঙ্গার ঘড়ি মিনার এই বছরেই তৈরী হয় আর সেই ঘড়ি মিনারের ঘড়িটি এখনও সচল। এই বছর বর্ধমানের বামুনপাড়া গ্রামে ‘পরশুরাম’ ওরফে রাজশেখর বসু জন্মগ্রহন করেন। তাঁর  ভূশন্ডির মাঠে, হনুমানের স্বপ্ন, গড্ডালিকা,কচি সংসদ, বিরিঞ্চিবাবা ও পরশপাথর ইত্যাদি বাংলা রচনা ও রামায়ন,মহাভারত, মেঘদূত ইত্যাদির বঙ্গানুবাদ তাঁর অন্যতম সাহিত্যকর্ম। তিনি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠিত ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস’ কোম্পানিতে পরিচালক পদে ছিলেন।

কলকাতার কথা কলকাতা বন্দরকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। আধুনিক কলকাতার গোড়াপত্তন কলকাতা বন্দরকে ঘিরেই। সেই কলকাতা বন্দরের আনুষ্ঠানিক পত্তনের দশক (১৮৭০-৮০) আর তৎকালীন বাংলার সমাজ জীবনের চালচিত্রই এই লেখার উপজীব্য। বিষয়ের উপর সীমিত জ্ঞান থাকার কারনে লেখার কাজে নিচে বর্ণিত অনেক বই, উইকিপিডিয়ার অনেক পেজের সাহায্য নিয়েছি। যদিও তথ্যগত ভুলের দায় আমার নিজস্ব এবং আশা পাঠকরা নিজে গুনেই সেটা মার্জনা করবেন।

সটীক হুতোম প্যাঁচার নকশা - অরুন নাগ

উইকিপিডিয়া

কোলকাতা বন্দরের মেরি টাইম আর্কাইভের বিভিন্ন তথ্য।